রাসেল মাহমুদ
অনিয়ম, দুর্নীতি, গ্রাহকের টাকা ফেরত না দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২০২০ সালের ২৮ জুন বেসরকারি খাতের জীবন বীমা কোম্পানি বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক বসায় বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ)। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সুপারিশে সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব হুমায়ুন কবিরকে কোম্পানিটির প্রশাসক করা হয়। দেড় বছর দায়িত্ব পালনের পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি হুমায়ুন কবিরকে সরিয়ে বোর্ড পুনর্গঠন করে কর্তৃপক্ষ। নতুন বোর্ডে চেয়ারম্যান করা হয় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও কলম্বিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান চৌধুরীকে।
নতুন বোর্ড ডুবন্ত কোম্পানিকে টেনে তোলার প্রত্যয়ে দায়িত্ব নিলেও গত দেড় বছরে তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। উল্টো কোম্পানির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পদে যখন-তখন নিয়োগ ও ছাঁটাই কোম্পানির স্বাভাবিক গতি ব্যহত করেছে। ফলে ডুবতে থাকা কোম্পানিটি কার্যত আরও ডুবছে। কোম্পানিটির গ্রাহকসহ কর্মকর্তাদের কেউ কেউ বায়রা লাইফকে ‘মৃতপ্রায়’ কোম্পানিও বলে থাকেন।
তবে ‘মৃতপ্রায়’ এই কোম্পানিকে উজ্জীবিত করতে গত জুনে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে নতুন মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। পদটিতে নিয়োগ পেয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। যিনি দেশের শীর্ষ বীমা কোম্পানিগুলোতে কাজ করেছেন। জাহাঙ্গীর আলম গত ৬ থেকে ৭ বছর বীমা পেশার বাইরে ছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুনে বায়রা লাইফে যোগদানের পরই কোম্পানির ব্যবসাবৃদ্ধিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে শুরু করেছেন জাহাঙ্গীর আলম। তার অংশ হিসেবে ‘ম্যাজিক প্ল্যান’ নামের একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়ে আগাচ্ছেন তিনি। কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ম্যাজিক প্ল্যানে ভর করে কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধির চিন্তা করছেন নতুন সিইও।
এদিকে ম্যাজিক প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য নতুন টিম গঠনের কাজ করছেন সিইও জাহাঙ্গীর আলম। পাশাপাশি টিম মেম্বারদের নিয়ে করছেন কর্মশালা। তবে এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে শুরু থেকেই বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের (আইডিআরএ) বেঁধে দেওয়া জনবল কাঠামোর নিয়ম ভাঙার অভিযোগ উঠেছে। বীমা কোম্পানির জনবল কাঠামোতে ৯টি লেয়ার বা গ্রেড থাকলেও বায়রা লাইফ জনবলকে ৫টি গ্রেডে নিয়ে এসেছে। বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা নিয়মের ব্যত্যয়।
বায়রা লাইফের করা কর্মকর্তাদের ৫টি গ্রেডের মধ্যে রয়েছে- গ্রেড-৫ ফাইন্যান্সিয়াল এসোসিয়েট (এফএ), গ্রেড-৪ ইউনিট ম্যানেজার (ইউএম), গ্রেড-৩ ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার (বিএম), গ্রেড-২তে রাখা হয়েছে-এজিএম, ডিজিএম, জিএম এবং এসজিএমকে। আর গ্রেড-১-এর মধ্যে রাখা হয়েছে ইডি, এসইডি, এএমডি এবং ডিএমডিকে।
সিইও জাহাঙ্গীর আলম বাণিজ্য বার্তার কাছে দাবি করেন, কমিশন কমিয়ে কোম্পানিকে উজ্জীবিত করতেই লেয়ার কমানো হয়েছে।
তিনি বলেন, আইডিআরএ ৯টি পদের কথা বললেও অনেক কোম্পানি নিজেদের ব্যবসায়ী পলিসির কারণে পদ কমিয়ে কাজ করে। বায়রা লাইফও খরচ কমাতে পদ কমিয়ে ৫টি গ্রেডে নিয়ে এসেছে। পদগুলো ঠিকই থাকছে, শুধু ৫টি গ্রেডে ভাগ করা হয়েছে।
পদ কমিয়েছে এমন কয়েকটি কোম্পানির নামও জানান জাহাঙ্গীর আলম।
দেড় বছরে ৫ সিইও
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বায়রা লাইফের প্রশাসককে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তখন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়া হয় ৫ জন সিইও। বীমা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একজন সিইও নিয়োগ পাওয়ার পর কোম্পানির সামগ্রিক অবস্থা বুঝতেও কয়েকমাস সময় লেগে যায়। কিন্তু বায়রা লাইফের নিয়োগ পাওয়ারা সে সময় পাচ্ছেন না। এতে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যহত হচ্ছে।
জানা গেছে, প্রশাসককে অব্যাহতি দেওয়ার পর নতুন বোর্ড ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিইও পদে নিয়োগ দেয় প্রণব কুমার দাসকে। সিইও হওয়ার শর্ত পূরণ না করলেও শীর্ষ পদে তার ওপরই আস্থা রাখে বোর্ড। কিন্তু বোর্ড বেশি দিন তার উপর ভরসা করতে পারেনি। মাত্র তিন মাস দায়িত্ব পালনের পরই তাকে ছাঁটাই করে মফিজুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বোর্ড। এরপর দ্বিতীয় সিইও হিসেবে নিয়োগ পান আবু আহমেদ রানা। তার ভাগ্যও সুপ্রসন্ন হয়নি। মে এবং জুন মাস কাজ করলেও জুলাইয়ের আগেই তাকে ছাঁটাই করা হয়।
২০২২ সালের ১ জুলাই তৃতীয় সিইও হিসেবে নিয়োগ পান সুশান্ত প্রামাণিক। তিনি দায়িত্ব পালন করেন ৮ মাস।
সুশান্ত প্রামাণিকের দায়িত্বকালে গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়াসহ কোম্পানির কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে কঠোর হয় আইডিআরএ। কোম্পানির সম্পত্তি বিক্রি করে গ্রাহকের অর্থ ফেরতের নির্দেশ দেয় সংস্থাটি। কিন্তু কোম্পানিটি গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে পারেনি। পরে বোর্ড সুশান্ত প্রামাণিককে সরিয়ে ফের দায়িত্ব দেয় প্রণব কুমার দাসকে। চলতি বছরের মার্চের ১ তারিখে দায়িত্ব নিলেও প্রণব কুমার দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র ৩ মাস। কোম্পানি সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, প্রণব কুমার কোম্পানির সিইও হলেও তাকে মূলত অবলিখন বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে কোম্পানির স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
সবশেষ গত জুনে প্রণব কুমারকে সরিয়ে পঞ্চম সিইও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় জাহাঙ্গীর আলমকে। বর্তমানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন।
সিইও নিয়োগ ও গ্রাহকের দাবি পরিশোধের বিষয়ে জানতে বায়রা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান চৌধুরীর মুঠোফোনে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি।
মন্তব্যের বিষয়টি জানিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠালে কয়েক ঘণ্টা পর ক্ষুদে বার্তায় মফিজুর রহমান চৌধুরী বলেন, আমি ব্যক্তিগত কাজে ঢাকার বাইরে আছি। বিষয়গুলো নিয়ে সিইও’র সঙ্গে কথা বলেন।